গত চার মাস কিংবা তারও বেশি সময় ধরে কারাবন্দি থাকার পর এবার একেকজন করে মুক্তি পাচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। সাড়ে তিন মাস পর গতকাল বৃহস্পতিবার(১৫ ফেব্রুয়ারি) কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। একই দিন কাশিমপুর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। গত কয়েক দিনে কারামুক্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতা। এ ছাড়া জামিন পেয়ে মুক্তির অপেক্ষায় আছেন অনেকেই। শীর্ষ নেতাদের মুক্তিতে দলটি নতুন করে চাঙ্গা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই নিরুত্তাপ। রাজপথে নেই জোরালো কোনো আন্দোলন। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো অনেকটা রুটিন কর্মসূচি পালন করছে। এ মুহূর্তে সংগঠন গোছানোতেই বেশি মনোযোগ তাদের। সেইসঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ায় কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্ত করার বিষয়েও তৎপর রয়েছে বিএনপি।
অনেকের মতে, নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মেয়াদে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ অনেকটাই নমনীয়। এ কারণেই জামিনে একের পর এক মুক্ত হচ্ছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এর আগে গত বছর সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে একদফা আন্দোলন জোরদার করে বিএনপি। সেই সময় আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নেয় সরকার। বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর মামলা দায়ের করা হয়। দফায় দফায় চলে গ্রেপ্তার অভিযান। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের কয়েকদিন আগে থেকেই গ্রেপ্তার শুরু হয়। ওই সমাবেশকে ঘিরে ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় সংঘাতের পর দলের অনেক সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারা দেশে শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান।
বিএনপির তথ্যমতে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের আগে থেকে জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ১৮৪টির বেশি মামলায় ১ লাখ ৫ হাজার ৬৮৪ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এ সময়ে ২৭ হাজার ৫১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেওয়া হয়। তবে এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাকর্মী কারামুক্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করতে নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমাতে সারা দেশে ক্র্যাকডাউন শুরু করে। আমাদের দলের মহাসচিবসহ অসংখ্য শীর্ষ নেতা এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বেআইনিভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশের আইন ও বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকলে মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার নেতাকর্মীরা শুরুতেই জামিন পেতেন।’
এক বছরে রেলের লোকসান ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা
তিনি বলেন, ‘দলের আইনজীবীরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বেশকিছু নেতাকর্মী কারামুক্ত হয়েছেন। এটা কিছুটা হলেও স্বস্তির সংবাদ। আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কারাবন্দি সবাই মুক্তি পাবেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জামিন এবং মুক্তি না মিললেও এখন তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সরকারের নমনীয় মনোভাবে সম্প্রতি আইনি প্রক্রিয়ায় তা আরও গতিশীল হয়েছে। এ কারণে কারাগারে আটক বেশির ভাগ নেতাকর্মী জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এখনো কারাগারে থাকা নেতাকর্মীদের মুক্তির প্রক্রিয়াও দ্রুত এগোচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
জানা গেছে, এখনো কারাগারে আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব, নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি, ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর, আলী আকবর চুন্নু, আজিজুর রহমান মোসাব্বির, সাবেক কাউন্সিলর শামীম পারভেজসহ অনেকে। মির্জা আব্বাসের ২টি এবং আলতাফ হোসেন চৌধুরীর ১টি মামলায় জামিন হলেই তারা কারামুক্ত হবেন বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের যেসব শীর্ষ নেতা সম্প্রতি কারামুক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক, তানভীর আহমেদ রবিন, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ফজলুর রহমান খোকন, যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল মোনায়েম মুন্না, গোলাম মাওলা শাহীন, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজ, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সভাপতি মেহেদী হাসান রুয়েল, বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ডা. রাকিবুল ইসলাম আকাশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব আমান উল্লাহ আমান।
ছাত্রলীগ নেতার আমরণ অনশন
গতকাল কারামুক্ত হয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গণতন্ত্র ফেরত না আসা এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’
বিদ্যালয় গেল গোয়ালঘরে, বই গেল পাটক্ষেতে
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা কিছুটা হলেও হতাশায় ভুগছেন। এ অবস্থায় তাদের সক্রিয় রাখার পথ খুঁজছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। এরই অংশ হিসেবে ঢাকাসহ সারা দেশে ছয়দিনের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে সর্বোচ্চসংখ্যক নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে সারা দেশে সাংগঠনিক সফর এবং রোজার আগে ঢাকায় সমাবেশের কথাও চিন্তা করা হচ্ছে।
বিএনপির ছয় দিনের কর্মসূচি অংশ হিসেবে গত মঙ্গল ও বুধবার ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরে গণসংযোগ এবং লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। মিয়ানমারে গোলাগুলির ঘটনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিহতদের স্মরণে আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মোনাজাতের কর্মসূচি রয়েছে বিএনপির। এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি সব জেলা শহরে এবং ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি সব উপজেলা, থানা, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করা হবে।
বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের শিকার হন। বাকিরাও আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। এতে বিভিন্ন স্তরে সাংগঠনিক শূন্যতা তৈরি হয়। তারপরও নেতাকর্মীরা যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এখন কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই কারামুক্ত হওয়ায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি জোরালো হবে।
নেত্রকোনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মো. আনোয়ারুল হক বলেন, ‘সরকারের পদত্যাগের দাবিতে একদফার আন্দোলনে দলের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুনভাবে উদ্দীপনা তৈরি করবে। দলের শীর্ষ নেতারা নতুন যে সিদ্ধান্ত জানাবেন আমরা তা পালনে সক্রিয় থাকব।’
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি বলেন, ‘মহাসচিবসহ অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন—এটি খারাপের মধ্যেও স্বস্তিদায়ক খবর। দলের হাইকমান্ডের নতুন দিকনির্দেশনায় আমরা সব কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকব।’
ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত সাবেক জেনারেল প্রাবোও সুবিয়ান্তো
সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘হামলা-মামলা উপেক্ষা করেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মাঠে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। এখন শীর্ষ নেতাদের কারামুক্তির পর নতুন সিদ্ধান্ত এলে আমরা আগের মতোই মাঠে থাকব।’